শ্রীকৃষ্ণ

'ভগবান' শব্দটি সংস্কৃত।এর অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনি- "(১) সমগ্র ঐশ্বর্য (ধনসম্পদ), (২) সমগ্র বীর্য (শক্তিমত্তা), (৩) সমগ্র য্শ, (৪) সমগ্র শ্রী (সৌন্দর্য, রূপবত্তা), (৫) সমগ্র জ্ঞান ও (৬) সমগ্র বৈরাগ্য যাঁর মধ্যে পূর্ণ-রূপে বর্তমান, সেই পরম পুরুষ হচ্ছেন ভগবান ৷"

এজগতে সকলেরই ঐসব ঐশ্বর্য কিছু কিছু পরিমাণে রয়েছে।কিন্তু কেউই দাবী করতে পারে না যে তাঁর মধ্যে ঐ ছয়টি বৈশিষ্ট্য একসাথে পূর্ণরূপে বিদ্যমান।একমাত্র ভগবানেরই এগুলি পূর্ণমাত্রায় থাকে৷আর শ্রীকৃষ্ণই সেই ষড়ৈশ্বর্য পূর্ণ পরমেশ্বর ভগবান।

১) শ্রীকৃষ্ণ পরম সম্পদশালী : ভগবদ্ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন (১০/৮),

"আমি জড় ও চেতন জগতের সব কিছুর উৎস৷ সব কিছু আমার থেকেই প্রবর্তিত হয়৷ সেই তত্ত্ব অবগত হয়ে পণ্ডিতগণ শুদ্ধ ভক্তি সহকারে আমার ভজনা করেন৷"

পৃথিবীতে লীলাবিলাসকালে শ্রীকৃষ্ণ য্খন দুরাচারী নরকাসুরকে বধ করেন, তখন তার কারাগৃহে বন্দী ১৬০০০ রাজকন্যা তাদেরকে গ্রহণ করার জন্য শ্রীকৃষ্ণে কাছে প্রার্থনা করে৷ শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের প্রার্থনা পূর্ণ করে তাদের সকলকে দ্বারকায় নিয়ে যান এবং প্রত্যেকের জন্য একটি করে অত্যন্ত সুরম্য বিশাল অট্টালিকার ব্যবস্থা করেন, এইরকম প্রত্যেক প্রাসাদে ছিল শোভাময় মোজেইক-রাস্তা, সুন্দর উদ্যান, হাজার হাজার দাস-দাসী, মণি-রত্নখচিত অনন্যসুন্দর আসবাবপত্র৷ বৈকুণ্ঠ জগতের গ্রহলোকগুলিতে ঐরকম কোটি কোটি অতিসুরম্য অট্টালিকা ও মহা-ঐশ্বর্য বিদ্যমান, এবং শ্রীকৃষ্ণই সকল ঐশ্বর্যের অধীশ্বর৷

২) শ্রীকৃষ্ণ পরম শক্তিমান : শ্রীকৃষ্ণের বয়্স য্খন মাত্র সাত বছর, তখন তিনি তাঁর বাঁহাতের কনিষ্ঠ আঙুলটির সাহায্যে একটা গোটা পর্বত তুলে ধরেছিলেন-- ইন্দ্রের সৃষ্ট অবিশ্রান্ত বর্ষণ থেকে ব্রজবাসীদের রক্ষা করার জন্য৷ সেই গোবর্দ্ধন পর্বতটি এখনো বৃন্দাবনে রয়েছে, ২২ কিলোমিটার যার পরিধি, আর পাঁচ হাজার বছর আগে এটি আরো বড় ছিল৷ কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সহজেই পর্বতটি ধরে রেখেছিলেন-- কয়েক মুহূর্তের জন্য নয়-- সাতদিন সাত রাত্রি ধরে৷

শ্রীকৃষ্ণের অলোকসামান্য বীর্যবত্তার এটি একটি দৃষ্টান্ত৷পরবর্তীতে, অর্জুনকে তিনি বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন, যা দর্শন করে অর্জুনের মতো বীরও ভয়ে কাঁপছিলেন৷

৩) শ্রীকৃষ্ণ সর্বাপেক্ষা য্শস্বী : কৃষ্ণের অপর নাম 'উত্তমশ্লোক'৷শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধে ভগবান বলেন, "একজন বিজ্ঞানী ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত পরমাণুও গণনা করতে সক্ষম হতে পারেন, কিন্তু আমার মহিমা বর্ণনা করতে কেউই সমর্থ নয়৷ আমরা যদি আকাশকে কাগজ হিসাবে ব্যবহার করি, বিশ্বের সমস্ত বৃক্ষগুলিকে লেখনী আর সমস্ত মহাসমূদ্রগুলিকে কালি হিসাবে ব্যবহার করি, তবুও সেগুলি ভগবানের গুণগাথার বর্ণনা এমনকি শুরু করার পক্ষেও যথেষ্ট হবে না৷সারা ভারতে শ্রীকৃষ্ণের যশমহিমা প্রচারের জন্য লক্ষাধিক মন্দির রয়েছে৷শুধু বৃন্দাবনেই রয়েছে পাঁচ হাজার মন্দির৷ পৃথিবীর এমন কোনো দেশ, কোনো শহর নেই, যেখানে শ্রীকৃষ্ণের দিব্য শ্রীমন্দির নেই৷

৪) শ্রীকৃষ্ণ পরম রূপবান : ভগবদ্গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁর রূপের দ্বিভূজ নরাকার রূপকে দুর্লভ দর্শন বলেছেন (সুদুর্দর্শম্ ইদং রূপং-১১/৫২)৷ ব্রহ্মসংহিতায় তাঁর রূপের অনবদ্য বর্ণনা রয়েছে- তিনি ত্রিভঙ্গললিত, গোপবেশ তাঁর মস্তক ময়ূর-পুচ্ছ যুক্ত উষ্ণীষ-শোভিত, তাঁর নয়্নদ্বয় পদ্মের পাপড়ির মতো আয়্তাকার ও সুকোমল, তাঁর গলদেশে শোভমান বৈজয়ন্তীমালা, তাঁর সুন্দর অধরে শোভিত মোহন মুরলী; তাঁর গাত্র বর্ণ ঘন মেঘের মতো নীলাভ, তিনি দিব্য আভরণ ভূষিত সুন্দরাঙ্গ, তিনি নিত্য-নব-নবায়্মান যৌবন সম্পন্ন৷যুগযুগ ধরে পৃথিবীর মানুষ শ্রীকৃষ্ণের অনুপম রূপ-মহিমার গুণ-গান করে আসছে৷

৫) শ্রীকৃষ্ণ সর্বজ্ঞ : জড় দেহধারী কেউই তার অতীতের লক্ষ লক্ষ জন্মের কথা স্মরণ করতে পারে না, সে তার ভবিষ্যত জীবন সম্বন্ধেও কিছু বলতে পারে না৷ কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "হে অর্জুন!পরমেশ্বর ভগবানরূপে আমি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণরূপে অবগত৷ আমি সমস্ত জীব সম্বন্ধে জানি, কিন্তু আমাকে কেউ জানে না৷" (ভ.গী.৭/২৬) 

৬) শ্রীকৃষ্ণ পরম বৈরাগ্যবান : কেউ য্খন উপরোক্ত ঐশ্বর্যগুলির একটিরও অধিকারী হয়, তখন স্বভাবতই সে ঐগুলির , তখন স্বভাবতই সে ঐগুলির প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ও গর্বিত হয়ে পড়ে৷ কিন্তু ঐ সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণ বিন্দু মাত্রও ঐসবের প্রতি আসক্ত নন৷মহাভারতে, য্খন রাজসূর্য যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির ব্যাসদেবের সংগে পরামর্শ করার পর তার বিভিন্ন আত্মীয়্স্বজনদের বিভিন্ন সেবা করার ভার দেন৷তখন সকলকে সব দ্বায়িত্ব বন্টন করার পর সমস্ত অভ্যাগত অতিথিবর্গ ও ব্রাহ্মণদের আশীর্বাদ লাভের জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ব্যক্তিগত ভাবে তাদের পদ ধৌত করার ভার নেন ও গভীর যত্ন সহকারে সেই দায়িত্ব সম্পাদন করেন৷

এইভাবে পরম ঐশ্বর্যশালী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরম বৈরাগ্য প্রদর্শন করেন৷